চিত্রনায়িকা পরীমনি ও মডেল পিয়াসার রাতের রঙ্গশালার নেটওয়ার্ক বিশাল। শোবিজের আলোচিত এ দুই তারকার অপকর্মে জড়িত সমাজের বিত্তশালী অন্তত ১৩ জন। এদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে তদন্ত সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এর মধ্যে ৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আসছে। এ ব্যাপারে দাপ্তরিকপত্র জারি করে তা বিমানবন্দর ও দেশের সীমান্ত পয়েন্টগুলোতে পাঠানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
যে ১৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে তারা মাঝেমধ্যেই পরীমনি ও পিয়াসার রাতের আসরের অতিথি হতেন। তাদের নিয়ে যেতেন লংড্রাইভে। পরীমনি-পিয়াসার মাধ্যমে ফাঁদ পেতে সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিতেন। এ কাজে পিয়াসার অধীনে ২০-২৫ জন অনিন্দ্য সুন্দরী তরুণী রয়েছেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এদের সবার নাম বলেছেন পরীমনি ও পিয়াসা। এ দুই শোবিজ তারকার সঙ্গে এসব বিত্তশালীদের মোবাইল ফোনের কথোপকথনের রেকর্ড ও অনেক স্থিরচিত্র পেয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। এগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ওমর ফারুক বলেন-পরীমনি, পিয়াসা, মৌ, রাজসহ প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জব্দ করা আলামত সম্পর্কে জানতে চাওয়া হচ্ছে। তদন্তে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এ মুহূর্তে তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গ্রেফতার ব্যক্তিদের প্রতারণা, অনৈতিক কার্যক্রম ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মতো অপকর্মে জড়িত নানা পেশার অনেক নাম জানা গেছে। এসব যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা যাদের নাম বলেছে তাদের সশ্লিষ্টতা সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে যুগান্তরের কথা হয় অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার সঙ্গে যিনি পরীমনি, পিয়াসা ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরের মামলার তদন্ত তদারকি করছেন। তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে পরীমনি, পিয়াসা ও নজরুল রাজ প্রভাবশালী যেসব ব্যক্তির অন্ধকার জীবনের উপাখ্যান তুলে ধরে যে তথ্য দিচ্ছেন তা বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার মতো। কারণ সমাজের নামকরা এসব ব্যক্তি স্বনামধন্য। বাইরে থেকে দেখে তাদের নৈতিকস্খলনের ভয়াবহ এসব বিষয় বোঝার উপায় নেই। তবে পরীমনি ও পিয়াসার দেওয়া তথ্যগুলো খুবই স্পর্শকাতর হওয়ায় সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হতে এদের সিআইডি কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যাদের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি হতে যাচ্ছে এদের দুজন বেসরকারি দুটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, একজন মিডিয়া হাউজের মালিক, একজন জুয়েলারি ব্যবসায়ী ও একজন প্রতিষ্ঠিত একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। রঙ্গশালাঘনিষ্ঠ অন্যদের মধ্যে নাম এসেছে ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক কোম্পানি ও দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি শিল্প গ্রুপের মালিক ও তাদের বখে যাওয়া সন্তানের। পরীমনি ও পিয়াসার সঙ্গে এদের মোবাইল ফোনে কথোপকথনের রেকর্ড যেমন তদন্তকারীদের হাতে এসেছে, তেমনি রিমান্ডে থাকা পরীমনি, পিয়াসা, রাজ, মিশু হাসান ও জিসানের কাছ থেকে জব্দ করা মোবাইল ফোন থেকেও প্রাথমিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও ও ছবি পাওয়া গেছে। আরও তথ্য সংগ্রহ করতে মোবাইল ফোনগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষা করা হবে।
জিজ্ঞাসাবাদে পিয়াসার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে সূত্র আরও জানায়, নামকরা জুয়েলারি মালিক পিয়াসাকে নিয়ে তার এক বাসায় আসর বসাতেন। সেখানে একজন ভারতীয় নাগরিকও থাকতেন। ভারতীয় ওই নাগরিকও ঢাকায় জুয়েলারি ব্যবসা করেন। যে বাসায় আসর বসানো হতো ওই বাসার কেয়ারটেকার রাজিয়া সবকিছু দেখাশোনা করতেন। ওই জুয়েলারি ব্যবসায়ীর সঙ্গে মডেল পিয়াসার ঘনিষ্ঠ ছবিও পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে মোবাইল ফোনে কথোপকথনের রেকর্ড। পিয়াসার দেওয়া এ তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য রাজিয়াকে ডেকে পিয়াসার মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
তদন্ত সূত্র জানায়, দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ফার্নিচার কোম্পানির মালিকের এক ছেলে মাঝেমধ্যেই পিয়াসার আসরে হাজির হতেন। পিয়াসার নারী নেটওয়ার্কের সদস্যদের দিয়ে তিনি নানা অপকর্মেও জড়িত। তার সঙ্গে পিয়াসার নাচের ভিডিও ও ফোনে কথোপকথনের রেকর্ড পাওয়া গেছে পিয়াসার মোবাইল ফোনে। দেশের একটি বহুজাতিক কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে পরীমনির কথোপকথনে অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারীরা। এছাড়াও গুলশানের একটি অভিজাত ফ্যাশন হাউজের মালিকের স্ত্রীর সঙ্গে ছিল পিয়াসা ও মৌর অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ফ্যাশন হাউজের মালিকের ওই স্ত্রীর সঙ্গে একটি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তার পরকীয়া চলছিল। এটাকে পুঁজি করে ব্ল্যাকমেইলের ফাঁদ পেতেছিল পিয়াসা ও মৌ। এ ঘটনার জেরেই তারা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন মৌ। ব্যাংক থেকে শত কোটি টাকার ঋণ পেতেও পিয়াসার সিন্ডিকেটের নারীদের ব্যবহার করা হতো বলে তথ্য দিয়েছেন পিয়াসা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের এক নেতার সঙ্গে পিয়াসার হোয়াটসআপ বার্তা দেখে অবাক হয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদকালে সমাজের উত্তবিত্তদের কাছে উঠতি বয়সি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সুন্দরী তরুণীদের ভোগের সামগ্রী বানানোর কথা স্বীকার করে তথ্য দেন পিয়াসা। তিনি জানান, এ কাজে শাকিল নামের আরেক যুবক পৃথক একটি নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করেন। তারও মূল ব্যবসা নারীদের দিয়ে ফাঁদ পেতে বাণিজ্য। গুলশান ২ নম্বর এলাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলের আশপাশেই তার অবস্থান। তার সম্পর্কে খোঁজখ২বর নিচ্ছে সিআইডি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে-রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে পরীমনি, পিয়াসা ও নজরুল রাজ যাদের নাম প্রকাশ করেছেন তাদের অনেকেরই আপত্তিকর মুহূর্তের ছবি এরই মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এদের মধ্যে দু-একজনের নগ্ন ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে। এতে এ জগতে যাতায়াতকারীদের রীতিমতো ঘুম হারাম। তাদের দাম্পত্য জীবনেও শুরু হয়েছে কলহ। এরইমধ্যে পিয়াসাকাণ্ডে যাদের নাম ও ছবি পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে তাদের কয়েকজন রোববার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের অফিসে একত্র হন। তারা এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে করণীয় ঠিক করতে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করেন।
সিআইডির ব্রিফিং: রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির কার্যালয়ে রোববার সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক। তিনি বলেন, শনিবার একসঙ্গে ছয় আসামির বাসায় তল্লাশি চালিয়ে কিছু আলামত ও ডিভাইস উদ্ধার করা হয়েছে। ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, পাসপোর্ট, মোবাইল, হার্ডডিস্ক ও ফেরারি গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। তদন্তের অংশ হিসাবে এ তল্লাশি অভিযান।
সিআইডির এই অতিরিক্ত ডিআইজি আরও বলেন, ‘আমরা যে মামলাগুলো তদন্ত করছি তা প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মাদকসংক্রান্ত। অন্য বিষয়ে তথ্য বা অভিযোগ এলে বা থেকে থাকলেও আমরা আমলে নেব।’ সিআইডির হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে থাকা ছয় আসামির বিরুদ্ধেই মাদক রাখা ও পার্টির নামে জিম্মি ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো ভুক্তভোগী পাওয়া গেছে কিনা জানতে চাইলে সিআইডির এ কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো ভিকটিম অভিযোগ করেননি। তবে আমরা বেশকিছু ভিকটিমের নাম জেনেছি। আমরা পরীমনি ও পিয়াসাদের ব্ল্যাকমেইলের সত্যতা পেয়েছি। জিজ্ঞাসাবাদে যাদের নাম এসেছে তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছি। কোনো ইনোসেন্ট লোক যাতে ক্ষতি বা মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার না হন সেটিও আমরা বিবেচনায় রেখেছি। পুরোপুরি সত্যতা ছাড়া আমরা কারও নাম ডিসক্লোজ করছি না। যদিও কিছু পত্রিকায় সিআইডির বরাতে নাম আসছে। তবে এসব তথ্য সিআইডি দেয়নি।
আরেক প্রশ্নের উত্তরে ওমর ফারুক বলেন, সত্যিকারের ভিকটিমদের আমরা খুঁজছি। তাদের বক্তব্য আমরা শুনব। আমরা পুরোপুরি সত্যতার ভিত্তিতে জড়িতদের আটক করব, জিজ্ঞাসাবাদ করব। পরীমনির বাসায় তল্লাশির বিষয়ে তিনি বলেন, সেখান থেকে অনেক কিছুই জব্দ করেছি। তা ফরেনসিক পরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীমনিসহ ৬ আসামির ব্ল্যাকমেইল ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত কাউকে ছাড় দেবে না সিআইডি। তদন্তের স্বার্থে পরীমনিসহ আমাদের হেফাজতে থাকা প্রত্যেক আসামিকে প্রয়োজনে ফের রিমান্ড আবেদন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
পরীমনির সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েন শিথিলের সম্পর্কটা কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে যতগুলো মামলা আসছে তার বেশিরভাগই মাদকসংক্রান্ত। তবে যদি অন্য কোনো বিষয় থেকে থাকে তাহলে আমরা তদন্তের মধ্যে নিয়ে আসব।